বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫, ১০:২৭ পূর্বাহ্ন

বাঘায় পদ্মার চরে আখ চাষ করে কৃষকের মুখে সাফল্যের হাসি

বাঘা (রাজশাহী) প্রতিনিধি::

যোগাযোগ বিছিন্ন জনপদ রাজশাহী বাঘার পদ্মার চরাঞ্চল। কষ্ট জাগানিয়ার ভিন্নতর ইতিহাস গড়া অঞ্চল। একটা সময় ছিল প্রতি বছর আশ্বিন-কার্তিক মাসে কর্মসংস্থান আর খাদ্যের অভাব দেখা দিত। মঙ্গার কারণে ঘরে খাবার নেই, মাঠে কাজ নেই, গবাদিপশুর খাবার নেই, অনাহারে অর্ধাহারে জীবন চলত এলাকার অধিকাংশ মানুষের। কয়েক বছর আগেও কষ্টের করুণ পরিণতিতে মাঝে মধ্যে বাকস্তব্ধ হয়ে যেতো। কর্মসংস্থানের অভাবে নিরুপায় হয়ে আগাম শ্রম বিক্রি করতে হতো। ঘামের ফসল সব সঞ্চয় জমা বিকিয়ে দুমুঠো ভাতের জোগান পাওয়ার জন্য চেষ্টা করত।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম আর আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা মঙ্গাকে জাদুঘরে নিয়ে গেছে আখের আবাদ। মঙ্গাকে গুডবাই জানিয়েছে কয়েক বছর আগেই। বর্তমানে সেখানকার পুরুষ মহিলাদের কর্মচাঞ্চল্যতা এখন প্রাণের উচ্ছ্বাসে টইটম্বুর। যে কারণে চরাঞ্চলের জনপদ ধানসহ অন্যান্য ফসলের পর সেখানে চিবিয়ে খাওয়া এবং গুড় তৈরির উপযোগী আখের জাত চাষ করে আপদকালীন সময়ে বাড়তি আয়ের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব হয়েছে।

সাফল্যে পেয়ে আখের আবাদ বেড়েছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মার চরাঞ্চলে। একানকার মাটি এঁটেল দো-আঁশ হওয়ায় গত কয়েক বছরে বেশ সফলতা পেয়েছেন কৃষকরা। তিনবার সেচের প্রয়োজন হলেও সার ও কীটনাশক তেমন ব্যবহার করতে হয় না বলেই কম পরিশ্রমে ও অল্প ব্যয়ে বেশি সফলতা পেয়ে নতুনরাও আখ চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এবার দ্বিগুন আখের আবাদ হয়েছে পদ্মার এই চরাঞ্চালে। তাই আখের তুলনায় ধান, পাট ও অন্যান্য ফসল আবাদে খরচ বেশি হওয়ায় এসব ফসল চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা।

চরের আখচাষীরা জানান, বন্যা কিংবা জলাবদ্ধতা থেকে ফসলহানির আশঙ্কা নিশ্চিতভাবে দূর করে। বিশেষ করে অন্যান্য ফসল চাষ করে যখন বন্যার হাত থেকে রক্ষা করে তা ঘরে তুলতে পারেন না, সেখানে আখ প্রায় ১২-১৫ ফুট লম্বা হয় এবং বন্যাসহিষ্ণু আখের জাত চাষাবাদের মাধ্যমে বন্যা কিংবা জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। আখচাষী আব্দুল মান্নান জানান,চরের ৬০ বিঘা জমিতে এবার আখের আবাদ করেছেন। আরেক চাষি লিটন জানান, তিনি ৫০ বিঘা জমিতে আখের আবাদ করেছেন। ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্রে পরিবহন খরচ বাদে প্রতি বিঘা আবাদে তাদের খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা। এবার প্রতিবিঘার আখ বিক্রি করতে পারবেন ৩৫ হাজার টাকা। আবাদ শুরু থেকে ইক্ষু কেন্দ্রে পরিবহনসহ খরচ হয় প্রায় ২৪ হাজার টাকা।

উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, উপজেলার গ্রামগুলোতে আখ চাষ করে আশানুরূপ ফলনও পেয়েছেন কৃষকরা । আধুনিক পদ্ধতিতে ভালো জাতের আখ চাষ করে স্বাবলম্বীও হয়েছেন অনেকে। চলতি মৌসুমে উপজেলায় ২ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। গত বছর আখ আবাদ হয়েছিল ১হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে। সেই তুলনায় এবার ১ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে আখের আবাদ বেশি হয়েছে। এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১লাখ ২৪ হাজার ৩৫৬ মেঃটন। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ৫৫ হাজার ৪৩০ মেঃটন।

সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখে গেছে, বালুময় পতিত যে চরে বিঘাপ্রতি ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকার ধইঞ্চা হতো, ধইঞ্চা ছাড়া অন্য কোনো ফসল হতো না, সে চরেও এবার ৫০ হাজার টাকার আখ বিক্রি করতে পারবেন চাষীরা। এ অঞ্চলের দারিদ্র্য নিরসনে স্থায়ীভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে আখের আবাদ । চারা তৈরি থেকে শুরু করে ও আখ কাটা, পরিবহন, গুড় তৈরি, বিক্রয় ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে গ্রীস্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত শীত, বসন্তে দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা অবদি পরম মমতায় নিবিড়ভাবে শ্রম বিনিয়োগে ব্যস্ত থাকে চরের গহীন সীমাহীন চত্বরে।

আখ চাষ থেকেই দেখা যায়, বারোমাসী ফসল বলে শ্রমিকরা সারা বছর তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পেরেছেন। এতে প্রাথমিক লাভ পাচ্ছেন জমির মালিকগণ। দ্বিতীয় সুবিধাভোগীরা হচ্ছেন মাঠের শ্রমিক। কেননা অন্যদিকে কাজের সুযোগ পেয়ে লাভ করছেন আরো দুটি শ্রেণি ০১. গুড় উৎপাদনকারী ০২. গুড় ব্যবসায়ী। মানুষের নিত্যদিন ব্যবহারের জন্য চর এলাকার উৎপাদিত শতভাগ বিশুদ্ধ, স্বাস্থ্যসম্মত নির্ভেজাল গুড় বিক্রির জন্য চলে যায় দেশের বিভিন্ন বাজারে। প্রতি কেজি গুড় কমপক্ষে ৫০ টাকা হারে বিক্রি হয়। এছাড়া আখের ছোবড়া জৈবসার ও জ্বালানি এবং আখ পাতা জ্বালানির উৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে অভাবণীয় কাজ করে। পাশাপশি ধান, পাট, হুলুদ সরষিাসহ সবজির আগাম ফলন, উৎপাদন পেয়েছে কৃষকরা।

উপজেলা কৃষি অফিসার সফিউল্লাহ সুলতান জানান, উপজেলার চরাঞ্চালসহ অধিকাংশ জমি আখ চাষের উপযোগী। সময়মতো আখের চারা রোপণ করতে পারলে ফলন ভালো হয়। তবে চরাঞ্চলের মাটির গুণগত মান খুবই ভালো। তাই বর্তমানে ধান ও পাটের তুলনায় আখ চাষে খরচ কম হওয়ায় চরের কৃষকরা আখ চাষের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন।
উপজেলার গড়গড়ি ইক্ষুক্রয় কেন্দ্রের ইনচার্জ আয়ুব আলী জানান, উপজেলায় এবার বিভিন্ন জাতের আখের আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে চর এলাকায় আবাদ হয়েছে ,ঈশ্বরদী-৩৩,৩৪,,৩৯ ও ৪০ জাতের আখ। চিবিয়ে খাওয়া আখের মধ্যে রয়েছে গ্যান্ডারী অন্যতম। তার কেন্দ্রের অধীনে প্রায় সাড়ে ৪শ কৃষক ৯০০ একর জমিতে আখের আবাদ করেছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com